Sale!

উমরাহ সফরের গল্প

Original price was: ৳ 330.00.Current price is: ৳ 248.00.

Description

লেখক : আরিফ আজাদ
প্রকাশনী : সুকুন পাবলিশিং
বিষয় : ভ্রমণ, হজ্জ-উমরাহ ও কুরবানি
সম্পাদক : উস্তায আহমাদ তামজিদ হাফি
পৃষ্ঠা : 184,
কভার : পেপার ব্যাক,
সংস্করণ : 1st editon, 2025
আইএসবিএন : 978-984-99705-2-1,
ভাষা : বাংলা

 

ভোরে উদিত হওয়া সূর্য সন্ধ্যাবেলায় অস্ত যায়। সকালে নীড় ছেড়ে যাওয়া পাখি নীড়ে ফেরে সন্ধ্যায়। জাগতিক জীবনে শুরু আছে এমন সকল ঘটনার সমাপ্তিও অবশ্যম্ভাবি। ফলে, মদিনায় আমার স্বপ্নময় দিনগুলোও ফুরিয়ে এলো।

 

প্রিয় কাউকে ছেড়ে যাওয়ার আগে অশ্রুসজল চোখে বারবার পেছন ফিরে তাকানো, খানিক এগিয়ে গিয়ে পুনরায় থমকে যাওয়া, আবার পেছন ফিরে তাকানো, হৃদয়ের সমস্ত আকুতি সমেত দৌড়ে তার কাছে ফিরে আসতে চাওয়া, তাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদবার অভিলাষ—মাসজিদ আন নববিকে ছেড়ে আসার দিন এ-সমস্তটাই ছিল আমার অনুভূতি। বিয়োগব্যথার এমন অব্যক্ত যন্ত্রণা, এমন হাহাকার করা শুন্যতা হৃদয়ে আগে কখনো অনুভব করিনি।

 

এখানকার প্রতিটা ইট যেন আমার অতি আপন। প্রতিটা বালুকণা যেন জীবন্ত হয়ে কথা বলত আমার সাথে। এই তল্লাট, মাঠঘাট, খেজুর বাগান, এখানকার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন আর বৃষ্টিভেজা মুহূর্তগুলোর সাথে যেন আমি যুগ যুগ ধরে পরিচিত। মদিনার বাতাস এত স্নিগ্ধ, এত নির্মল যে, মনে হতো জান্নাতের সীমানা মাড়িয়ে একটুকরো পরাণ জুড়ানো শীতল হাওয়া এসে গায়ে মাখামাখি হচ্ছে। মদিনার আকাশ, সেই আকাশের মেঘ কিংবা রাত্রিবেলার তারকারাজি—সমস্তটাই যেন এক কল্পরাজ্যের সাজানো ঘটনা।

 

হেঁটে হেঁটে আমি দেখতাম মদিনা শহরকে। মাসজিদ আন নববির খোলা চত্বরটা ছিল আমার ভীষণ প্রিয় জায়গা। এই চত্বরে হেঁটে বেড়াতে দারুন ভালো লাগত। যেখানে ইচ্ছে হতো বসে পড়তাম।

 

সালাত আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির-আযকার করা। আবার হাঁটতে মন চাইলে উঠে হনহন করে হাঁটা ধরতাম। হেঁটে হেঁটে দেখতাম এই গলি থেকে ওই গলি, এই চত্বর থেকে ওই চত্বর, এই পাশ থেকে ওই পাশ। মাসজিদ আন নববির চারপাশ হেঁটে দেখতে আমার কী যে ভালো লাগত! মনে হতো একটা জাদুর গালিচা বিছানো আমার পায়ের নিচে, আর আমি হেঁটে হেঁটে দেখছি জান্নাতের সুরম্য দালানকোঠা, সুবিন্যস্ত সজ্জা, আলোকোজ্জ্বল প্রদীপমালা।

 

এখন তো সবখানে টাইলস আর কার্পেট মোড়ানো, কিন্তু আল্লাহর রাসুলের সময়ে এসব ছিল না। তখন ছিল পাথুরে শক্ত মাটি। এখানে-ওখানে পাথরের ঢিবি। জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল খেজুর গাছ। দখিনা বাতাসে দোল খেতো সেসব গাছের ডাল।

 

এই পাথুরে শক্ত মাটিতে, শুকনো খেজুর পাতার ছাঁটাই বিছিয়ে বসে থাকতেন আমার রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। দূরে দূরে সাহাবাদের ঘরদোর। সেই ঘরগুলোর অধিকাংশও খেজুর পাতার চাটাইয়ে তৈরি। তাদের ঘরের দরোজায় ঝুলতো একফানা লম্বা কাপড়, যাতে বাইরের কারো দৃষ্টি ঘরের মধ্যে আসতে না পারে। আশেপাশে ছিল পানির কুয়ো। যে যার মতো করে উঠাচ্ছে পানি। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে উট কিংবা বকরির পাল। কেউ হয়তো বেরিয়েছে ব্যবসার উদ্দেশ্যে, অথবা কোনো রাখাল হয়তো দূরের কোনো প্রান্তরে চরিয়ে আনতে যাচ্ছে তার পশুগুলো।

 

এই সেই সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগের মদিনা। এত সাদামাটা, নিবিড় আর নির্ঝঞ্চাট!

 

এইসব ঘটনার ফাঁকে, আকাশের সূর্য যখন হেলে পড়ত পশ্চিমে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু ছুটে আসতেন মাসজিদ আন-নববির চত্বরে। আরশের মালিক অপূর্ব সুর লহরি দান করেছিলেন তাঁর গলায়! তিনি গলা ছেড়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিতেন সালাতের আহ্বান—আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…

 

আমি সবসময় ভাবি, হৃদয়প্রাণ ডুবিয়ে আযানে বিলাল যখন ‘আশহাদু আল লা ইলালা ইল্লাল্লাহ’ বলে টান দিতেন, তিনি কি ভীষণ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তেন তখন? স্মৃতিরা এসে কি ভর করত তাঁর মনের জানালায়? ইসলামের শুরুর দিনগুলোতে, মক্কার সেই বৈরী পরিবেশে তিনি যখন তাওহিদের বুলন্দ আওয়াজ ‘আহাদ’ শব্দকে বানিয়েছিলেন নিজের বেঁচে থাকার রসদ, তাঁর বুকের ওপর তুলে দেওয়া পাথর কিংবা উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে রেখে অত্যাচারের স্মৃতিগুলো তাঁকে কি ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যেত?

 

বুকের ওপর পাথরের ভার, শরীরে তপ্ত বালুর দহন, কিন্তু বিলালের বুক ভর্তি ঈমানের সুধা। পাথরের ভারে বেরিয়ে যেতে পারে প্রাণ, তপ্ত বালু পুড়িয়ে কয়লা করে দিতে পারে শরীর, কিন্তু বিলাল তার বিশ্বাসে পাহাড়ের মতো অবিচল।

 

আমি ভাবতাম—আযানে ‘আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে গেলে খানিক সময়ের জন্য হলেও কি ধরে আসত বিলালের গলা? চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ত ভালোবাসার অশ্রু?

 

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর গলায় আযানের সুর ছড়িয়ে পড়ত সর্বত্র। মদিনার প্রতিটা ঘরে ঘরে লেগে যেত তোড়জোড়—সালাতের সময় হয়েছে। আল্লাহর রাসুল এসে দাঁড়াতেন মিম্বরের পাশে। তাঁর ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াতেন আবু বাকার, উমার, উসমান, আলি, আবু যর, আবু হুরায়রা, আবু আইয়ুব আনসারিসহ অসংখ্য সাহাবি। রাদিয়াল্লাহু আনহুম। পেছনে মহিলাদের সারিবদ্ধ দল। চারপাশ থেকে ভেসে আসতো ছোট ছোট শিশুদের কলকাকলি। হেসেখেলে তারা মাতিয়ে রাখত মাসজিদ আন নববি।

 

নবিজি যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সালাত আরম্ভ করতেন, সকলের মনোযোগ এসে নিবদ্ধ হতো সিজদাহর জায়গায়। আল্লাহর রাসুলের হৃদয় শীতল করা তিলাওয়াতের মাঝে তারা হারিয়ে যেতেন। তারা ডুবে যেতেন ভাবনার এমন অতলান্তে যেখানে বান্দা এবং তার রব ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো পক্ষ নেই।

 

মাসজিদ আন-নববির চত্বরে বসে আমি আকাশের দিকে তাকাই। এই তো সেই জৌলুস-ভরা আকাশ যেটা সমস্তকিছুর সাক্ষী। এই তারকারাজি, রাতের আকাশের আলোকোজ্জ্বল এই পূর্ণ চন্দ্র—এরা সুদূর অতীতেও ছিল। কত নিবিড়ভাবে এরা দেখতে পেয়েছে আমাদের রাসুলকে!

 

আমার মদিনার দিনগুলো ফুরিয়ে এলো সত্যি সত্যিই। একটু পর হোটেলের সামনে থেকে রওনা করবে আমাদের গাড়ি। হাতে আছে সাকুল্যে এক ঘণ্টা। আমার সাথের লোকজন প্রায় সবাই হোটেলে চলে গেছে যুহর সালাতের পর পর। আমারও খানিকটা প্রস্তুতি দরকার ছিল। লাগেজপত্র গোছানো হয়নি মোটেও। কিন্তু, নববির চত্বর ছেড়ে হোটেলে ফিরতে আমার একটুও ইচ্ছে করছিল না। কোনো এক অজানা শক্তি যেন আমার পা জোড়া আটকে দিয়েছে নববির চত্বরে।

 

আমি সবুজ গম্বুজটার দিকে তাকাই আর অশ্রুতে ভরে উঠে আমার দু’চোখ। আমার প্রিয় রাসুল, আল্লাহর প্রিয় হাবিব শুয়ে আছেন আমার থেকে অল্প একটু দূরে। খানিক বাদে আমি চলে যাব এই মদিনা ছেড়ে। হোটেল থেকে ছুটে এসে এই সবুজ গম্বুজ আমি আর দেখতে পাব না, এত কাছাকাছি এসে আর বলতে পারব না আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ। আবু বাকার, উমার, উসমান আর আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুমাদের মতো পবিত্র আত্মাদের স্মৃতিবিজড়িত এই তল্লাটে এসে স্মৃতির পাতায় হারানোর সুযোগ আর থাকছে না—ভাবতেই যেন বুকের ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়।

 

কিন্তু, আমি তো আরব নই। এক অনারব নবিপ্রেমিক। পশ্চাতে রেখে এসেছি বহু বন্ধন। আমাকে এবং আমার মতো আরও লাখো কোটি অনারব নবিপ্রেমিককে ফিরে যেতে হয় বুক ভরা বিয়োগব্যথা নিয়ে। ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বাকি কবরস্থান। সেই নিশ্চুপ নিরুপদ্রব জায়গা যেখানে অনন্তের বিশ্রাম নিচ্ছেন হাজারো সোনার মানুষ। এই তো সেই বাকি কবরস্থান যেখানে আল্লাহর রাসুল একদিন খুব লম্বা করে দুয়া করেছিলেন। দুয়া করার এক পর্যায়ে তিনি আওড়ে বললেন, ‘আহা, আমি যদি আমার ভাইদের দেখে যেতে পারতাম!’

 

রাসুলের পাশে ছিলেন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু। নবিজির মুখে এমন অপূর্ণতায় ভরা আফসোস দেখে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা কি আপনার ভাই নই?’

 

জবাবে আল্লাহর রাসুল বললেন, ‘তোমরা হলে আমার সাথি। আমার ভাই তো তারা যারা আমাকে না দেখেও বিশ্বাস করবে। যারা আমার সংস্পর্শ না পেয়েও আমাকে ভালোবাসবে। তারা তো এখনো দুনিয়াতে আসেনি।’

 

ত্রস্ত পায়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি হোটেলের দিকে। পেছনে রেখে যাচ্ছি মাসজিদ আন নববি। কিছুদূর যাই, আবার পেছনে ফিরে তাকাই। আবার হাঁটি, আবার পেছনে ফিরে একনজর দেখে নিই সবুজ গম্বুজটাকে। আমি হাঁটছি আর অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে বুক। বুকের ভেতর ভীষণ ধুকপুকোনি। অবিশ্রান্তভাবে যেন বেজে চলেছে হৃদপিণ্ডটা। সেখানে লেগে গেছে জোর গুঞ্জরন—আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।

 

( লেখাটি ‘উমরাহ সফরের গল্প’ বই থেকে নেওয়া। অধ্যায়টির নাম—‘আলবিদা, মদিনা’।)

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “উমরাহ সফরের গল্প”

Your email address will not be published. Required fields are marked *